
মোঃ আতিকুর রহমান, রাজশাহী জেলা প্রতিনিধি:
৪০ ফুটের মধ্যে শিশুর অবস্থান শনাক্ত না হওয়ায় নতুন করে আবারও খনন কাজ শুরু ২১ ঘণ্টা পার—উদ্বেগে পরিবার, আহাজারি মায়ের; আল্লাহ তার জন্য ধৈর্যের তৌফিক দিন
রাজশাহীর তানোরে গভীর নলকূপে পড়ে যাওয়া শিশুটিকে উদ্ধারের মরিয়া প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তবে দীর্ঘ ২১ ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরও শিশুর অবস্থান সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করা না যাওয়ায় উদ্ধার অভিযান আরও জটিল হয়ে পড়েছে। উদ্ধারকারীরা নতুন পরিকল্পনায় আবারও খনন কাজ শুরু করেছেন। প্রতিটি মুহূর্ত যেন এখন শিশুটির পরিবারের জন্য অসহনীয় সময় হয়ে উঠছে।
গতকাল সকালে হঠাৎ করেই প্রায় ৩০ ফুট গভীর নলকূপে পড়ে যায় শিশুটি। গ্রামের লোকজন প্রথমে স্থানীয়ভাবে উদ্ধার করতে চেষ্টা চালালেও নলকূপের সরু ব্যাস ও অন্ধকার গহ্বরের কারণে তা সম্ভব হয়নি। খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায় ফায়ার সার্ভিস, স্থানীয় প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবীরা। প্রথম থেকেই সময়ের বিরুদ্ধে লড়ছেন তারা।
প্রথম ধাপে ধারণা করা হয়েছিল শিশুটি ৩০ ফুটের মধ্যে রয়েছে। সে অনুযায়ী উদ্ধারকারীরা ক্যামেরা, শব্দ শনাক্তকারী ডিভাইসসহ আধুনিক যন্ত্রপাতি নলকূপে নামিয়ে তার অবস্থান নিশ্চিত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু টানা চেষ্টা সত্ত্বেও শিশুর অবস্থান চিহ্নিত করা যায়নি।
পরে আরও গভীরে অনুসন্ধান চালানো হলে ৪০ ফুট পর্যন্তও শিশুর সন্ধান পাওয়া যায়নি। এতে উদ্ধারকাজ আরও কঠিন হয়ে পড়ে। সংকীর্ণ, অন্ধকার, গভীর এই নলকূপে কাজ করতে গিয়ে উদ্ধারকর্মীদেরও বিপদে পড়তে হচ্ছে। এরপরই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়—শিশুটিকে পৌঁছানোর জন্য নতুন করে পাশ দিয়ে একটি বড় ব্যাসের গর্ত খনন করা হবে।
সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারী যন্ত্রপাতি এনে আবারও খনন কাজ শুরু করা হয়েছে। প্রতিবারই আশা জাগলেও হতাশ হয়ে ফিরে আসতে হচ্ছে উদ্ধার কর্মীদের। তবুও তারা এক মুহূর্তের জন্যও থামছেন না।
ঘটনাস্থলে মুহূর্তে মুহূর্তে মানুষের ভিড় বাড়ছে। নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ, তরুণ—সবাই উৎকণ্ঠায় খোঁজ নিচ্ছেন উদ্ধার কাজের অগ্রগতি। কেউ দোয়া করছেন, কেউ কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। শিশুর একটি সামান্য শব্দ শুনলেও আশা জাগে, আবার শূন্যতা ফিরে আসে।
সবচেয়ে হৃদয়বিদারক দৃশ্য শিশুটির মায়ের কান্না। সকাল থেকে রাত, রাত থেকে সকাল—২১ ঘণ্টা ধরে তিনি সন্তানের কোনো খবর না পেয়ে বারবার ভেঙে পড়ছেন। মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন, আবার উঠে সন্তানকে ডাকছেন। তার এই আর্তনাদে আশপাশের মানুষও অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়ছেন।
স্থানীয়রা তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন, কিন্তু মায়ের ব্যাকুলতা সামলানো কারো পক্ষেই সম্ভব হচ্ছে না। উপস্থিত সবারই একটাই কথা—
“আল্লাহ যেন সেই মাকে অতুলনীয় ধৈর্যের তৌফিক দান করেন।”
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অভিযান থামানোর কোনো প্রশ্নই আসে না। শিশুটি জীবিত বা অজ্ঞান—যাই হোক না কেন—তাকে বের করে আনতেই হবে।
এক কর্মকর্তা বলেন,
“এটা মানবিক উদ্ধার। আমরা জানি সময় অনেকটা পার হয়ে গেছে, কিন্তু আমরা হাল ছাড়ছি না। যতক্ষণ প্রয়োজন হবে, ততক্ষণ এই অভিযান চলবে।”
স্থানীয় প্রশাসনও উদ্ধার অভিযান তদারকি করে যাচ্ছে। পুলিশের অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে, যাতে অনাকাঙ্ক্ষিত ভিড়ে কাজ ব্যাহত না হয়। ঘটনাস্থলে অ্যাম্বুলেন্স ও চিকিৎসা টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
জেলার বাইরে থেকেও অনেক মানুষ জানাচ্ছেন উদ্বেগ ও শুভকামনা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিশুটির জন্য দোয়ার ঝড় উঠেছে। সবাই একটাই আশা নিয়ে অপেক্ষা করছেন—শিশুটিকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হবে।
সময়ের কাঁটা যত এগোচ্ছে, উদ্বেগ তত বাড়ছে। তবুও আশা হারাচ্ছেন না কেউই। উদ্ধারকর্মীদের অমানুষিক পরিশ্রম, প্রশাসনের তৎপরতা ও মানুষের দোয়া—সব মিলিয়ে একটাই লক্ষ্য: শিশুটিকে যে কোনোভাবে নিরাপদে ঘরে ফেরানো।