দম্ভ ও অহংকার – ধ্বংসের পথ দৈনিক চৌকস দৈনিক চৌকস প্রকাশিত: ১২:৩৫ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২০, ২০২৫ আল্লাহর স্পষ্ট বাণী:_ “নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না সেই ব্যক্তিকে, যে দাম্ভিক ও অহংকারী।” (সূরা আন-নিসা: ৩৬)। আল্লাহর বাণী: অর্থ: আর তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর ও কোন কিছুকে তাঁর শরীক করো না; এবং সদ্ব্যবহার (ইহসান) করো পিতা-মাতার প্রতি; আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, অভাবগ্রস্ত, নিকট প্রতিবেশী, দূর-প্রতিবেশীর প্রতি, সঙ্গী-সাথী, মুসাফির ও তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের প্রতি। নিশ্চয় আল্লাহ পছন্দ করেন না দাম্ভিক, অহংকারীকে (৪:৩৬)। এই আয়াতের প্রেক্ষাপটে আমরা দেখতে পাই, আল্লাহ আমাদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন, সদ্ব্যবহার করার জন্য তাদের প্রতি যারা আমাদের পিতা-মাতা, আমাদের আত্মীয়-স্বজন, আমাদের প্রতিবেশী; এবং মিসকীন, পথচারী এবং দাস-দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করতে। কিন্তু এই সদ্ব্যবহার তখনই অর্থবহ হয়, যখন কারো মধ্যে অহংকার ও দম্ভ না থাকে। *নিশ্চয় আল্লাহ পছন্দ করেন না দাম্ভিক, অহংকারিকে — এর ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ:* আল্লাহ তা’আলা মানুষের মধ্যে বিনয়, নম্রতা, এবং অপরের প্রতি দয়ালু আচরণ পছন্দ করেন। যারা নিজেকে অন্যদের চেয়ে বড় মনে করে, অহংকার করে, তাদেরকে আল্লাহ পছন্দ করেন না। এই আয়াতে আল্লাহ বলছেন—তিনি এমন লোকদের পছন্দ করেন না যারা: অহংকারী — নিজেদের শ্রেষ্ঠ মনে করে, দম্ভভরে কথা বলে। আত্মপ্রশংসাকারী — নিজ গুণ বা সম্পদের অহংকার করে। এগুলো এমন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, যা মানুষকে ধ্বংস করে দেয়—দুনিয়াতে এবং আখিরাতে। *দাম্ভিক ও অহংকারীর বৈশিষ্ট্য:* (ক). সবসময় নিজের কথা বড় করে বলা। (খ). অন্যদের কথায় পাত্তা না দেওয়া। (গ). নিজের সম্পদ, জ্ঞান, বংশ ইত্যাদি নিয়ে অহংকার করা। (ঘ). কাউকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা। (ঙ). ক্ষমা চাইতে না পারা। (চ). ভুল স্বীকার না করা। *দম্ভ এবং অহংকারের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা:* মানসিক স্বাস্থ্যবিদ্যার ভাষায়—(ক). অহংকার অনেক সময় Inferiority Complex (হীনমন্যতা) ঢাকতে আসে। (খ). দাম্ভিকতা একটি ‘আত্মমুগ্ধ ব্যক্তিত্ব বৈকল্য’ – Narcissistic Personality Disorder (NPD)-এর লক্ষণ হতে পারে। এটি একধরনের মানসিক সমস্যা, যেখানে একজন ব্যক্তি অতিরিক্ত আত্মপ্রেমে ভোগে, নিজের গুরুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে অতিরঞ্জিত ধারণা পোষণ করে এবং অন্যদের অনুভূতির প্রতি সহানুভূতিশীল হয় না। অহংকারী ও দাম্ভিক আচরণ করে। (গ). এটি Empathy বা সহানুভূতির ঘাটতি সৃষ্টি করে। (ঘ). এমন মানুষদের সাথে দীর্ঘমেয়াদে কেউ সম্পর্ক রাখতে চায় না। *কুরআনের অন্যান্য আয়াতে দাম্ভিকতা ও অহংকারের নিষেধ:* “আমি আমার নিদর্শনসমূহ হতে তাদের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেব যারা পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে অহংকার করে।”(সূরা আল-আ’রাফ ৭:১৪৬)। “মানুষের প্রতি মুখ ফিরিয়ে অহংকার করো না এবং জমিনে গর্বভরে পদচারণা করো না।”(সূরা লুকমান ৩১:১৮)। “পৃথিবীতে গর্বভরে চলাফেরা করো না; তুমি কখনো জমিন বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং পাহাড়ের উচ্চতাও ছুঁতে পারবে না।” (সূরা আল-ইসরাআ ১৭:৩৭)। *হাদিসে দম্ভ ও অহংকার সম্পর্কে নিষেধ:* রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: “যার অন্তরে একটি সরিষা দানার সমপরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।” (সহীহ মুসলিম: ৯১)। এ হাদীস আমাদের জন্য কঠোর সতর্কবার্তা। *ইসলামিক দৃষ্টিকোণ:* ইসলামে আত্মমুগ্ধতা, অহংকার ও আত্মপ্রশংসাকে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: “তিন ব্যক্তির দিকে কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তাকাবেন না… তাদের মধ্যে একজন হলো: মিসকিনদের অবজ্ঞা করে দাম্ভিক ব্যক্তি।” (মুসলিম) _আরেকটি হাদীস:_ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: “গর্ব (অহংকার) হচ্ছে আমার চাদর, মহত্ত্ব হচ্ছে আমার পরিধেয় বসন। যে কেউ এদের মধ্যে যেকোনো একটিতে আমার সঙ্গে টানাটানি করে, আমি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব।” সহীহ মুসলিম, হাদীস: ২৬২০)। ব্যাখ্যা: এই হাদীসে মহান আল্লাহ তা’আলা অহংকার ও মহত্ত্বকে নিজের মর্যাদার প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এ দুটি গুণ শুধুমাত্র তাঁরই জন্য উপযুক্ত, কোনো মানুষের জন্য নয়। কেউ যদি অহংকার করে, তা হলে সে যেন আল্লাহর গৌরব ও মর্যাদার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চায়—যা একেবারেই অবৈধ ও ভয়ানক। এমন টানাটানি মানেই নিজেকে আল্লাহর সমকক্ষ মনে করা, আর তার পরিণতি হচ্ছে জাহান্নাম। *উপদেশ:* অহংকার মানুষের চরিত্রকে কলুষিত করে, আল্লাহর অসন্তুষ্টি ডেকে আনে। এই হাদীস আমাদের সতর্ক করে দেয় যেন আমরা কখনো বিন্দুমাত্র অহংকার না করি। বিনয়ী হওয়া রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাহ। *অহংকারের পরিণতি কী:* ফিরআউন, নমরুদ, কারুন—তারা সবাই দম্ভে ভরা ছিল। আল্লাহ তাদের ধ্বংস করেছেন। আজও ইতিহাসে তারা ঘৃণিত। অহংকার ইবলিসের পথ। আসুন, আমরা বিনয় অবলম্বন করি। অহংকার থেকে নিজেকে রক্ষা করি। মানুষকে সম্মান করি। সত্যকে গ্রহণে লজ্জাবোধ না করি। আল্লাহর সামনে নিজেদের ছোট বানাই। *শিক্ষা ও উপদেশ:* (ক). ‘বিনয়’ নবীদের গুণ-বৈশিষ্ট্য। বিনয়বানদের আল্লাহ উত্তম মর্যাদা দেন। (খ). বিনয় ও নম্রতা মানুষের আসল গুণ। (গ). অহংকার মানুষকে আল্লাহর কাছে ঘৃণিত করে তোলে। (ঘ). ধন, বিদ্যা, পদ—সবই আল্লাহর দান। এগুলো নিয়ে অহংকার করা অজ্ঞতার নিদর্শন। (ঙ). বিনয়ী ব্যক্তি সমাজে সম্মান পায় এবং আখিরাতে জান্নাতে উত্তীর্ণ হয়। *উপসংহার:* দম্ভ ও অহংকার মানুষের আত্মাকে ধ্বংস করে। কুরআন ও হাদীস একবাক্যে এই চারিত্রিক দোষকে ঘৃণার চোখে দেখেছে। তাই একজন সচেতন মুসলমানের উচিত অহংকার ত্যাগ করে বিনয়, নম্রতা ও মানুষের প্রতি সদ্ব্যবহার করা। মনে রাখতে হবে—আল্লাহ দাম্ভিক ও অহংকারীদের পছন্দ করেন না। *আল্লাহ-হুম্মা সাল্লি, ওয়া সাল্লিম, ওয়া বারিক আ’লা মুহাম্মাদ; আল-হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ’লামীন*। (মূসা: ১৯-০৪-২৫)। (Collected) SHARES ধর্ম ও জীবন বিষয়: